কুরবানীর মাসআলা-মাসায়েল: ফরজ, সুন্নত ও বিধানসমূহ

কুরবানীর মাসআলা-মাসায়েল: ফরজ, সুন্নত ও বিধানসমূহ

কুরবানীর মাসআলা-মাসায়েল: ফরজ, সুন্নত ও বিধানসমূহ


কুরবানীর সংজ্ঞা ও মূল উদ্দেশ্য


কুরবানী শব্দের অর্থ হলো নৈকট্য লাভ করা। ইসলামী পরিভাষায়, নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে পশু জবাই করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কুরবানী প্রদান করা হয়।

কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন:

> "তাদের গোশত এবং রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না; বরং তাঁর নিকট পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।"

(সূরা হজ্জ: ৩৭)

এখান থেকে বোঝা যায়, কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাকওয়া অর্জন।


কুরবানীর বিধান (ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত)


কুরবানী কি ফরজ?


কুরবানী ফরজ নয়; বরং অধিকাংশ ফকীহদের মতে এটি ওয়াজিব। তবে কিছু ইমাম ও মাযহাব অনুযায়ী এটি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা (পাকা সুন্নত)।


হানাফী মাযহাব অনুযায়ী:

সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য কুরবানী ওয়াজিব।

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ কুরবানী না করে, তবে তার জন্য গুনাহের সম্ভাবনা আছে।


শাফেয়ী, মালিকী ও হাম্বলী মাযহাব অনুযায়ী:

কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।

তবে ত্যাগ করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।


কার উপর কুরবানী ওয়াজিব?


কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে:


১. মুসলিম হতে হবে।

২. বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হতে হবে।

৩. আqli (স্মরণশক্তিসম্পন্ন) হতে হবে।

৪. মুকীম (নিজ শহরে অবস্থানকারী) হতে হবে, মুসাফিরের উপর ওয়াজিব নয়।

৫. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে (যেমন যাকাতের জন্য নির্ধারিত সম্পদের পরিমাণ)।

৬. কুরবানীর নির্ধারিত দিনে (১০-১২ জিলহজ্জ) জীবিত থাকতে হবে।


কুরবানীর নির্ধারিত সময়


কুরবানী করার সময় হচ্ছে ১০ জিলহজ্জ ঈদের নামাজের পর থেকে শুরু করে ১২ জিলহজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

গ্রাম অঞ্চলে, যেখানে ঈদের নামাজ হয় না, সেখানে ফজরের পরপরই কুরবানী করা যাবে।

যদি কেউ ঈদের নামাজের আগে কুরবানী করে ফেলে, তাহলে সেই কুরবানী হালাল গোশত হবে, কিন্তু কুরবানীর সওয়াব পাওয়া যাবে না।


আরো পড়ুনঃকুরবানীর ইতিহাস ও তাৎপর্য | কুরবানী ঈদের পূর্ণ ব্যাখ্যা


কুরবানীর পশুর শর্তসমূহ


কুরবানীর জন্য পশুর কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে:


১. জাতীয়তা: উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি হতে হবে।

২. বয়স:


উট: ৫ বছর পূর্ণ।


গরু/মহিষ: ২ বছর পূর্ণ।


ছাগল/ভেড়া: ১ বছর পূর্ণ।

৩. দোষমুক্ত: পশুর চোখ, কান, লেজ ইত্যাদি ঠিকঠাক থাকতে হবে। গুরুতর রোগাক্রান্ত, পঙ্গু বা অন্ধ পশু কুরবানী গ্রহণযোগ্য নয়।


কুরবানীর সুন্নতসমূহ


কুরবানীর সময় কিছু আমল সুন্নত হিসেবে পালিত হয়:


১. ঈদের নামাজের আগে কিছু না খাওয়া (কুরবানীর পর খাওয়া)।

২. কুরবানীর পশুকে নিজ হাতে জবাই করা অথবা উপস্থিত থাকা।

3. পশুকে ভালোভাবে আচরণ করা, দয়া প্রদর্শন করা।

4. জবাই করার সময় "بِسْمِ اللّٰهِ، اَللّٰهُ أَكْبَرُ" বলা।

5. ধারালো ছুরি ব্যবহার করা এবং পশুকে দ্রুত ও কম কষ্টে জবাই করা।

6. পশুকে কিবলার দিকে মুখ করে শোয়ানো।

7. জবাইয়ের আগে পশুকে পানি পান করানো।


কুরবানীতে মাকরুহ কাজসমূহ


কিছু কাজ কুরবানীর ক্ষেত্রে মাকরুহ (অপছন্দনীয়) বিবেচিত হয়:


১. ছুরি ভোঁতা হওয়া।

২. পশুকে এক পশুর সামনে জবাই করা।

৩. জবাই করার পর সম্পূর্ণ মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার আগে পশুর চামড়া ছাড়ানো।

৪. পশুর প্রতি অবহেলা বা নিষ্ঠুরতা দেখানো।


কুরবানীর গোশতের বণ্টন বিধান


কুরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ করা উত্তম:


১. নিজের পরিবারের জন্য।

২. আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর জন্য।

৩. গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণের জন্য।


নিয়ম:


নিজের জন্য কিছু রাখা জায়েয।


সম্পূর্ণ গোশত দান করাও জায়েয।


গরিবদের দিতে না চাইলে বা সম্পূর্ণ নিজের জন্য রেখে দিলে কুরবানী আদায় হবে; তবে সুন্নাত পরিপূর্ণ হবে না।


বিকল্প পদ্ধতিতে কুরবানী


বর্তমানে অনেকে অনলাইন কুরবানী সার্ভিস বা আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে কুরবানী করে থাকেন। এটি শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ; তবে সম্ভব হলে নিজ হাতে কুরবানী করা বেশি ফজিলতপূর্ণ।


মহিলাদের কুরবানীর বিধান


যদি কোনো নারী নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন, তবে তার উপরও কুরবানী ওয়াজিব।

নারী চাইলে নিজে পশু জবাই করতে পারে অথবা অন্য কাউকে দিয়ে করাতে পারে।


যদি কুরবানী করার সুযোগ না হয়?


কোনো কারণে যদি কেউ কুরবানী করতে না পারে, তবে:

পশু কুরবানীর মূল্য দান করে দিতে পারে।

যদিও এই দান, মূল কুরবানীর বদলা নয়। বরং আল্লাহর নিকট মাফ চাইতে হবে।


গুরুত্বপূর্ণ হাদীস সমূহ


রাসূল (সা.) বলেছেন:

 "কুরবানীর দিনে আদম সন্তানের জন্য কুরবানী থেকে বেশি প্রিয় কোনো কাজ নেই। কিয়ামতের দিন সেই পশু তার শিং, রোম ও খুরসহ নিয়ে আসবে।"

(তিরমিজি: ১৪৯৮)


এছাড়া আরো বর্ণিত হয়েছে:

"যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকট না আসে।"

(ইবনে মাজাহ: ৩১২৩)


উপসংহার


কুরবানী ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর মাধ্যমে আত্মত্যাগ, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য এবং তাকওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়। তাই প্রতিটি মুসলিমের উচিত, যথাযথভাবে কুরবানীর মাসআলা-মাসায়েল জেনে কুরবানী পালন করা, যেন এই মহান ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয়।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url