কুরবানীর পশু নির্বাচন: ইসলামিক দৃষ্টিকোণ ও গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা

 

কুরবানীর উপযুক্ত পশু নির্বাচন ও ইসলামিক নির্দেশনা

কুরবানীর গুরুত্ব ও পশু নির্বাচনের ভূমিকা


কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত, যা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আদায় করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,


> "কেয়ামতের দিনে কুরবানীর পশুগুলোর শিং, রোম ও খুর নিয়ে হাজির করা হবে। পশু কুরবানী করার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়।" (তিরমিজি)

কুরবানী শুধু পশু জবাই নয়, এটি তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ। আর এই ইবাদত সুন্দরভাবে সম্পাদনের জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ ও নির্দোষ পশু নির্বাচন করা অপরিহার্য।


কুরবানীর পশুর ধরন ও বৈধতা

ইসলাম অনুসারে, কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রাণী বৈধ:


  • উট
  • গরু
  • মহিষ
  • ভেড়া
  • ছাগল

কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে:

"প্রত্যেক জাতির জন্যই আমি কুরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া পশু জবাই করে তাঁর নাম স্মরণ করতে পারে।" (সূরা হাজ্জ: ৩৪)


পশুর বৈধ বয়স নির্ধারণ


প্রত্যেক পশুর নির্দিষ্ট বয়সসীমা রয়েছে:

  • উট: ৫ বছর পূর্ণ
  • গরু/মহিষ: ২ বছর পূর্ণ
  • ভেড়া/ছাগল: ১ বছর পূর্ণ (বা উন্নত জাতের হলে ৬ মাসে বড় হলে বৈধ)


কুরবানীর পশুর শারীরিক গুণাবলী


কোন দোষগুলো থাকলে কুরবানী গ্রহণযোগ্য হবে না।

রাসূল (সা.) বলেছেন:

"চার ধরনের পশুর কুরবানী গ্রহণযোগ্য নয়: এক চোখ অন্ধ, সুস্পষ্ট রোগগ্রস্ত, সুস্পষ্ট খোঁড়া এবং অস্থিহীন রোগাক্রান্ত পশু।" (আবু দাউদ)

গ্রহণযোগ্য নয় এমন দোষগুলো:


  • এক চোখ অন্ধ
  • গুরুতর অসুস্থ
  • পাগল বা মারাত্মক দুর্বল
  • দৃষ্টিকটুভাবে খোঁড়া
  • কান, লেজ বা নাক সম্পূর্ণ কাটা



সুস্থ পশু নির্বাচন কিভাবে করবেন


  • চোখ, কান, লেজ ও পা ভালোভাবে পরীক্ষা করুন।
  • পশুর ত্বক পরিষ্কার এবং উজ্জ্বল কিনা দেখুন।
  • দাঁত দেখে বয়স যাচাই করুন।
  • হাঁটাচলা স্বাভাবিক কিনা নিশ্চিত করুন।
  • শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক কিনা লক্ষ্য করুন।


আরো পড়ুনঃকুরবানির মাংস বিতরণে ইসলামী বিধান: সম্পূর্ণ নিজের জন্য রাখা কি বৈধ?


নির্দিষ্ট পশুর বিস্তারিত নির্দেশনা


  • উটের ক্ষেত্রে শর্ত
  • বয়স কমপক্ষে ৫ বছর হতে হবে।
  • সুস্থ ও শক্তিশালী হতে হবে।
  • উটের মধ্যে সামান্য ক্ষত চলবে না।



গরুর ক্ষেত্রে শর্ত


  • বয়স কমপক্ষে ২ বছর।
  • গরু যদি বড়দেহী হয় তবে অল্প বয়সেও কুরবানী বৈধ (কিছু মত অনুযায়ী)।
  • এক গরু সাতজন পর্যন্ত কুরবানীতে শরিক হতে পারে (সর্বজনের নিয়ত সহীহ হতে হবে)।

ছাগল/ভেড়ার ক্ষেত্রে শর্ত


  • বয়স কমপক্ষে ১ বছর।
  • ছাগল এক ব্যক্তি কুরবানী করতে পারবে।
  • ভেড়া যদি ৬ মাসে বড় হয় তবে কুরবানী বৈধ।


পশু নির্বাচনের সময় করণীয় ও সচেতনতা


  • বাজারে পশু কেনার সময় কীভাবে যাচাই করবেন
  • বিক্রেতার কাছ থেকে পশুর বয়স নিশ্চিত করুন।
  • পশুকে হাঁটিয়ে পরীক্ষা করুন।
  • দাঁত গণনা করুন: দাঁত পুরো পড়লে বা বদলালে বয়স পূর্ণ হয়।
  • শ্বাসের গন্ধ এবং নাক পরীক্ষা করুন: অসুস্থতার লক্ষণ আছে কিনা।



অনলাইন কুরবানীর গাইডলাইন


  • বর্তমানে অনলাইন কুরবানী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিছু সতর্কতা:
  • বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান বা ফার্ম থেকে ক্রয় করুন।
  • পশুর সম্পূর্ণ ভিডিও/ছবি দেখে নিশ্চিত হোন।
  • স্বাস্থ্য সনদপত্র যাচাই করুন।
  • ডেলিভারির আগে পশু নিজে দেখে রিসিভ করুন যদি সম্ভব হয়।


ইসলামিক দৃষ্টিতে কুরবানীর পশু কেন গুরুত্বপূর্ণ


কুরবানীর পশু নির্বাচন আল্লাহর জন্য তাকওয়া প্রকাশের মাধ্যম। কুরআনে বলা হয়েছে:


> "তাদের গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে।" (সূরা হাজ্জ: ৩৭)




তাকওয়ার গুরুত্ব:


  • ইবাদত শুধুমাত্র নিয়ত ও আন্তরিকতার উপর নির্ভরশীল।
  • পশু নির্বাচনে অবহেলা তাকওয়ার ঘাটতি প্রকাশ করে।


নিয়তের বিশুদ্ধতা:


  • কুরবানীর মাধ্যমে আত্মত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে।
  • খ্যাতি বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কুরবানী করা হারাম।



কুরবানীর পশু নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নোত্তর


প্রশ্ন ১: গরুতে সাতজন শরিক হলে সবাই আলাদা উদ্দেশ্য নিয়ে কুরবানী করতে পারবে?

উত্তর: না, সকলের উদ্দেশ্য কুরবানী হওয়া আবশ্যক। কেউ আকিকা বা অন্য কিছু করতে চাইলে শরিক হওয়া যাবে না।


প্রশ্ন ২: একটি পশুর কোনো একটি ছোট দোষ থাকলে কুরবানী হবে কি?

উত্তর: যদি দোষটি সামান্য হয় (যেমন: সামান্য কান কাটা) এবং পশুর স্বাস্থ্যে প্রভাব না ফেলে, তবে কুরবানী বৈধ।


প্রশ্ন ৩: কুরবানীর পশু ওজনভিত্তিক নাকি বয়সভিত্তিক নির্ধারিত?

উত্তর: মূলত বয়সভিত্তিক নির্ধারিত, তবে সুস্থতা ও আকৃতি ওজনের মাধ্যমেও আন্দাজ করা যেতে পারে।


উপসংহার: 

কুরবানী ইবাদতের উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। তাই পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। একটি সুস্থ, নির্দোষ এবং বিধিমত পশু নির্বাচনের মাধ্যমে কুরবানীর প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর কাছে আমাদের পশুর রক্ত নয়, আমাদের অন্তরের তাকওয়া পৌঁছায়। আল্লাহ আমাদের সকলের কুরবানী কবুল করুন। আমীন।


রেফারেন্স:


  • কুরআনুল কারিম (সূরা হাজ্জ, আয়াত ৩৪ ও ৩৭)
  • সহীহ বুখারী
  • সহীহ মুসলিম
  • আবু দাউদ শরীফ
  • তিরমিজি শরীফ



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url